দার্জিলিং থেকে মেদিনীপুর, কুচবিহার থেকে বর্ধমান – গোটা পশ্চিমবঙ্গ থেকে সরকারি চাকরির স্বপ্ন দুচোখে মেখে প্রাক্তন ও নবীন মিলিয়ে প্রায় ৪০০০ ছাত্রছাত্রীদের সমাবেশ হয়ে উঠেছিল বারাসাত অ্যাডামাস নলেজ সিটি। RICE Education-এর ১৫তম সমাবর্তন অনুষ্ঠান আরম্ভই হল শিকাগো ধর্মসভায় স্বামী বিবেকানন্দের ভাষণে রুমেলা নৃত্যগোষ্ঠীর পরিবেশনার মধ্যে দিয়ে! বিদ্যাই সেই প্রথম আগুন যা মানুষকে দীপ্ত করে তোলে, প্রাণে সেই আগুনের স্পর্শ নিয়ে এই সমাবর্তনে ছাত্রছাত্রীরা শপথ নেয় ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে তারা কর্মে অবিচল হবে। আজকের ছাত্ররা সফল হয়ে কেবল এই রাজ্যে নয় সারা দেশের বিভিন্ন দপ্তরে নিজের নাম, প্রতিষ্ঠানের নাম, রাজ্যের নাম গৌরবান্বিত করবে, আর সফল ছাত্রছাত্রীরা এগিয়ে যাবে আরও বড় সাফল্যের দিকে। এই বৃহত্তর আহ্বানের নাম RICE Education, এই কর্মে অচল থাকার অনুপ্রেরণার নাম RICE Education!
সমাবর্তনের মঞ্চ থেকে প্রফেসর ড. সমিত রায় শোনালেন দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির তিল তিল গড়ে ওঠা, শিক্ষকদের অমিত পরিশ্রম এবং অবশ্যই ছাত্রছাত্রীদের অসম্ভব জেদ ও প্রতিবন্ধকতাকে কাটিয়ে উঠে সফলতা পাওয়ার কাহিনী। এই মঞ্চই তো পারে পিতা ও পুত্রের দুই প্রজন্মকে একই সঙ্গে পুরষ্কৃত করতে, যেহেতু এরা দুজনেই RICE Education-এর ছাত্র। সমর্পন বোস PSC-র অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস পরীক্ষায় পাশ করে ওয়েস্টবেঙ্গল অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস- সার্ভিসে কর্মরত। আজ থেকে ঠিক ৩০ বছর আগে ১৯৯৪ সালে সমর্পনের বাবাও SSC CGl-এ পাশ করেছিলেন এই RICE Education থেকেই! পিতাপুত্র একসঙ্গে যখন RICE Education-এর কর্ণধার প্রফেসার ড. সমিত রায়কে প্রণাম করে উঠে দাঁড়ান সেই তখন শিক্ষকের সেই গৌরবময় মুখভাব প্রতিষ্ঠানের সাফল্যের ঐতিহ্যে এক নতুন মুহূর্ত যুক্ত করে।
সাফল্যের পথ বড় কঠিন, নির্বান্ধব। পদে পদে বাধা বিঘ্ন, ব্যর্থতা, হতাশার মধ্যে দিয়ে এই পথ চলতে হয়। এই রকম ব্যর্থতার মধ্যে দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার গল্প শোনালেন এক্স অ্যডিশনাল চিফ সেক্রেটারি গভর্মেন্ট অব ওয়েস্টবেঙ্গল , হিডকোর প্রাক্তন চেয়ারম্যান দেবাশিস সেন মহাশয়। তাঁর আন্তরিক বক্তব্যে নিজের কথা বলতে গিয়ে বললেন, তিনি প্রথমবার IAS পরীক্ষায় সফল হতে পারেননি। দ্বিতীয়বারে আশাতীত প্রতিকূলতা পার করতে হল তাঁকে- প্রাকৃতিক দুর্যোগে, অর্থের অনটনে। কিন্তু সেইবারেই তিনি সফলতা পেলেন। তিনি বলেন পরীক্ষা কেবল খাতাকলমেই হয় না, শারীরিক, মানসিক, প্রাকৃতিক সব পরীক্ষাই পার করতে হয় বড় কোন সাফল্য পেতে হলে। তাই ব্যর্থতা মানে হেরে যাওয়া নয়, এর অর্থ নতুন আরম্ভ, যতবার ব্যর্থতা ততবার গোড়া থেকে আরম্ভ করা এই হোক নবীনদের মন্ত্র!
সরকারি চাকরির পরীক্ষায় সাফল্য কেবল নিজের স্বার্থসিদ্ধি বা নিশ্চিত কর্মজীবনের উদ্দেশে নয়। এর অন্যদিকটির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন প্রাক্তন পুলিশ কমিশনার নগরপাল গৌতম মোহন চক্রবর্তী। তিনি IPS-এর চাকরি এবং আমেরিকায় গিয়ে PhD করার সুযোগ পেয়েছিলেন একই সঙ্গে, কিন্তু পুলিশের চাকরিটিই তিনি বেছে নেন। তিনি মনে করিয়ে দেন সরকারি চাকরিতে যে কাজ করতে হয় তা মানুষের জন্য। সেই কাজ সাধারণ মানুষের জীবনে যখন সদর্থকতা বয়ে আনে তখন যে পরিতৃপ্তি পাওয়া যায় তা আর কোন কিছুতেই পাওয়া যায় না। পরীক্ষার্থী ও কৃতি দুই দলের জন্যই তিনি দুটি মন্ত্র দেন, বর্তমান পরীক্ষার্থীদের জন্য P-P-P: Passion, Perseverance ও Patience এবং সরকারি পদের জন্য A-B-C: Ability, Being brave, Courteious. অর্থাৎ সরকারি চাকরি পাওয়ার জন্য পরীক্ষার্থীদের গভীর আবেগ থাকতে হবে, অধ্যাবসায়ী হতে হবে আর ধৈর্য ধরতে হবে। অন্যদিকে সরকারি পদপ্রাপ্তদের জন্য তাঁর উপদেশ প্রতিনিয়ত যোগ্যতাকে প্রমাণ কর, কর্তব্যে সাহসী হও আর সরকারি পরিষেবা নিতে আসে যে গরিব, অসহায় মানুষেরা তাদের প্রতি উদ্ধত আচরণ করো না, বিনয়ী হতে শেখো।
মঞ্চে একসঙ্গে দুই শতাধিক কৃতি ছাত্রছাত্রীদের দেখে সত্যিই অভিভূত হতে হয়েছে, এদের মধ্যে অনেকেই তিনটে, চারটে এমনকি পাঁচটা চাকরি পেয়ে একটা বেছে নিয়েছেন। ‘সরকারি চাকরির আকাল’ এইরকম জনরবের মাঝখানে এই মঞ্চভরা সফল মুখ এক দৃষ্টান্তস্বরূপ। দেখতে দেখতে আশায় উদ্যমে ভরে ওঠে বুক। সেরার সেরা দুজন পেলেন আনকোরা নতুন গাড়ি। এ বছর WBCS-এ নবম স্থান অধিকার করেছেন স্বর্ণাভ হালদার। তাঁকে পুরস্কৃত করা হল অলটো গাড়ি দিয়ে। এ ছাড়াও গাড়ি পেলেন SSC CGL ২০২১-এ সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে দ্বাদশ এবং পশ্চিমবঙ্গে প্রথম স্থান অধিকারী রিয়া দত্ত। বর্তমানে তিনি অ্যাসিসটেন্ট অডিট অফিসার পদে কর্মরত। অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারেন নি RICE IAS-এর উজ্জ্বল ছাত্রী তমালী সাহা। Civil Services -এর মতো কঠিন পরীক্ষায় মাত্র ২৩ বছর বয়সে প্রথম প্রচেষ্টায় পাশ করে বর্তমানে সে Indian Forest Service (IFS) অফিসার হিসেবে নিযুক্ত। উত্তর ২৪পরগনার মেয়ে তমালী RICE Education-এর গর্ব। IFS ট্রেনিং-এ তমালী মুম্বাইয়ে থাকায় সমাবর্তনে উপস্থিত হতে না পারলেও শুভাচ্ছাবার্তা পাঠিয়েছেন একটি ভিডিওর মাধ্যমে। আগামী সমাবর্তনে তমালীকে অবশ্যই সংবর্ধিত করা হবে এই আশা রেখেই ১৫তম সমাবর্তন সমাপ্ত হল। অনুষ্ঠানে শিল্পী লগ্নজিতা চক্রবর্তীর গান, খাওয়া দাওয়া, অ্যাডামাসের খোলামেলা পরিসরে ছাত্রছাত্রীদের অবাধ বিচরণ এই দিনটিকে করে তুলেছিল অনন্য! লগ্নজিতা চক্রবর্তীর শেষ গানের রেশ রেখে সমাবর্তনের দিন অবসান হল, কিন্তু RICE Education-এর ছাত্রছাত্রীদের মনে গেঁথে দিয়ে গেল পরিশ্রমের মূলমন্ত্র, সাফল্যের জেদ!
Published on May 12, 2024